আমি তখন অফিসে বসে ছিলাম। হাতে কোন কাজ নেই। মে দিবসের এই দিনেও অফিস করতে হচ্ছে দেখে কিছুটা মন খারাপ। অবশ্য মন খারাপ করার উপায় নেই কারণ ছুটিটা আমরা একদিন আগেই পেয়ে গিয়েছিলাম। যাইহোক, বসে থাকতে থাকতে চোখে কিছুটা ঘুম ঘুম ভাব চলে আসছিল। মোবাইল ফোন দেখে সময়টা জেনে নিলাম। ঘড়িতে সময় ৩ টা ২৫ মিনিট। চা খাওয়ার উপযুক্ত সময় এটা। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম চা খেতে বের হব। তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। ঘুম ঘুম ভাব টাও যাবে আবার একটু ঘুরতেও পারব। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আমার আফিস গুলশান ২ এর পিংক সিটিতে। যাইহোক অফিস থেকে বের হয়ে ওয়ান্ডারল্যান্ডের উল্টো দিকে গুলশান থানার পাশের একটা ঝুপড়ি দোকানে গিয়ে বসলাম চা খেতে। দোকানদারকে চা দিতে বলে মোবাইলটা বের করলাম ফোন করার জন্য। ফোনে কথা বলতে বলতেই হাতে চা চলে আসল। ফোনে কথা বলতে বলতেই আমার চা পান করা চলছিল।
চা যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই ঘটল ঘটনাটা। আমি যেখানে বসে ছিলাম তার পাশেই রাস্তায় একটা সাদা মাইক্রো রাস্তার একপাশ দখল করে পার্ক করা ছিল। মাইক্রোর ড্রাইভিং সিটে চালক বসে ছিল। হটাৎ ড্রাইভার কি মনে করে দরজাটা খুলে দিল। ঠিক তক্ষুনি দুজন যাত্রীসহ একটা মোটরসাইকেল ওই দরজার উপর এসে পড়ল। দরজায় লেগে মোটরসাইকেলটি ছিটকে পড়ল মাইক্রোটির পাশে অর্থাৎ রাস্তার মাঝখানে। মোটরসাইকেলটি রাস্তায় পরে যাওয়ার পরপরই আরেকটা গাড়ি ছুটে আসে তাদের দিকে। অবশ্য দ্বিতীয় গাড়ির চালক সময়মত তার গাড়িটি থামাতে পেরেছিলেন। মোটরসাইকেলের চালক আর যাত্রী সময়মত মোটরসাইকেল থেকে নেমে যেতে পারায় আর দ্বিতীয় গাড়ির চালক সময়মত তার গাড়িটি থামাতে পারায় বড় দুর্ঘটনা ঘটে নি। অবশ্য মোটরসাইকেলের চালক পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছিল। সবকিছু ঘটে গেল এক মুহূর্তেই। মোটরসাইকেলের চালক আর যাত্রীর কিছুক্ষণ সময় লাগল সবকিছু বুঝে উঠাতে।
এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরও মাইক্রোটির চালক বের হয়ে এল না তাদেরকে সাহায্য করতে। অথচ সেই ছিল সবচেয়ে কাছে। তখন মোটরসাইকেলের যাত্রী মাইক্রোটির চালককে পিছনের দিক না দেখে দরজা খোলার কারণ জানতে চান। মাইক্রোটির চালক দুঃখ প্রকাশ না করে উল্টো মোটরসাইকেলের যাত্রীকে বলল “রাস্তার এত পাশে চাপিয়ে মোটরসাইকেল চালান কেন?” অথচ মোটরসাইকেলটি ঠিক রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মোটরসাইকেলের যাত্রী মাইক্রোটির চালককে বেশ কিছু চড় মারে। মাইক্রো চালকের সাহায্যকারীও মোটরসাইকেলের যাত্রীকে কিছু একটা বলায় তাকেও কিছু চড় খেতে হয়। তখন মাইক্রো চালকের সাহায্যকারী দৌড়ে পুলিশ ডাকতে গেল।
মাইক্রোচালকের সাহায্যকারী কিছুক্ষণ পর সাধারণ পোশাক (সিভিল ড্রেস) পরা একজন পুলিশকে ডেকে আনল। ততক্ষণে আমার চা খাওয়া শেষ। যার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম তাকে পরে ফোন করব বলে লাইন কেটে দিলাম। তারপর উৎসুক হয়ে আমিও ভিড়ে গেলাম দর্শকদের দলে। ঘটনাস্থলে যেতে যেতে মাইক্রোচালকের সাহায্যকারী পুলিশটির কাছে অনেককিছু বলে নালিশ দিল যার একটি ছিল মোটরসাইকেল আরোহীরা নাকি তাকে আর মাইক্রো চালককে গুলি করার হুমকি দিয়েছে। আশেপাশের যারা ছিলাম তাদের কেউই এরকম কোন কথা শুনিনি। তারপরও পুলিশ সদস্যটি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েই কোমর থেকে তার অস্ত্র বের করে মোটরসাইকেল চালকের মাথায় ধরে উচ্চস্বরে বলতে লাগল “ওই গুলির ভয় দেখাস? এক্কেবারে গুলি কইরা মাথার ঘুলি উড়াইয়া দিমু।” মাইক্রচালকের দোষ হলেও মোটরসাইকেল চালককে দোষারোপ করা হচ্ছে দেখে উপস্থিত জনতা পুলিশ সদস্যটিকে আসল ঘটনা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু ওই পুলিশ সদস্যটি কারো কথা না শুনে বা ঘটনা না জানতে চেয়ে বার বার মোটরসাইকেল আরোহীকে বলতে লাগল “তুই অগো মারছস কেন? মাস্তানি করস? মামলা হইব, আমি মামলা করমু”। এই সময় তার অস্ত্র তার হাতে ছিল। পাশে দাঁড়ানো দর্শকদের মধ্যে কোন এক ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র ছিল। ওই ছাত্র তখন পুলিশ সদস্যটিকে অস্ত্র বের করে কথা বলার কারণ জানতে চায়। এতে পুলিশ সদস্যটি ক্ষেপে গিয়ে ওই ছাত্রটিকে বলে “তুই অগো মারছস কেন?” উত্তরে ছাত্রটি “আমি তো মারি নাই” বলায় পুলিশ সদস্যটি তাকে বলে “তাইলে তুই এত কথা বলস কেন? চল থানায় চল। মামলা করমু ।” আর মোটরসাইকেল আরোহীদের কে গুলশান থানায় যেতে বলে। তখন মোটরসাইকেল আরোহীরা মোবাইল ফোন থেকে কাকে যেন ফোন করে ওই পুলিশ সদস্যটিকে কথা বলতে বলে। পুলিশ সদস্যটি হ্যালো বলার পর থেকেই চেহারা পাল্টে যায়। জী স্যার! জী স্যার! করে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন রেখে ভদ্র ভাষায় মোটরসাইকেল আরোহীদের বলল “আপনারা একটু থানায় আসুন”। মোটরসাইকেল আরোহীরাও তার সাথে থানার দিকে চলে গেল। অবাক হয়ে গেলাম এই দেখে যে পুলিশ সদস্যটি আসল ঘটনা জানতে চাইল না আর মাইক্রো চালক আর তার সাহায্যকারীকে কিছুই বলল না। আরও অবাক হলার এই ভেবে যে পুলিশ সদস্যটি কেমন করে মাস্তানদের মত মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখাল আর ফোনে কথা বলে চিমশে গেল। পরে জানতে পারলাম মাইক্রোটি পুলিশদেরই ছিল। বিভিন্ন অভিযানে তারা ওই মাইক্রোটি ব্যবহার করে আর তাই মাইক্রো চালক আর তার সাহায্যকারীকে কিছু বলে নি।
অনেকক্ষণ বাইরে ছিলাম দেখে আমি আর থানার দিকে যাইনি। অফিসে ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম মাস্তানদের থেকে রক্ষা করার জন্য পুলিশ আছে কিন্তু পুলিশের মাস্তানি থেকে আমাদের রক্ষা করবে কে? যাদের উপরের দিকে লোক আছে তার তো ফোন করেই বেঁচে যাবে। কিন্তু আমার মত যাদের উপরের দিকে লোক নেই তাদের বাঁচাবে কে?
[বিঃদ্রঃ সম্পূর্ণ ঘটনা সত্যি। ঘটনার তারিখ ও সময়ঃ পহেলা মে, ২০১২ বিকাল ৩:৩০ থেকে ৪:০০ টা পর্যন্ত]