বই পড়া নাকি অনেকের ভালো লাগে না। সারাদিন টেক্সট বুক পড়ার পর নাকি বইয়ের প্রতি আকর্ষণ আর থাকে না। আমার অবশ্য উল্টোটা হয়। টেক্সট বুকের উপর বিরক্ত হয়ে গল্প আর উপন্যাস পড়তে আমার বেশ লাগে। এটা আমার অনেক ছোটবেলার অভ্যাস। ক্লাসের বইয়ের নিচে তিন গোয়েন্দা আর প্রানের কমিক্স রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। আম্মার হাতে এটা নিয়ে প্রায়ই বকা খেতাম। মার খেয়েছিও যে কতবার তার হিসেব নেই। তবু বই পড়ার অভ্যাসটা ছাড়তে পারি নি। আমার মনে আছে আমার এস.এস.সি. পরীক্ষার ঠিক আগের দিনও বিকালে বাড়ীর ছাঁদে বসে কোন একটা উপন্যাস পড়েছিলাম। ঐ সময়টাতে জামার নিচে বই লুকিয়ে ছাদে নিয়ে যেতাম পড়ার জন্য।
একটা সময় বই আমার নিয়মিত সঙ্গী ছিল। বই পড়ে কত কেঁদেছি আর কতদিন যে মন খারাপ করে রেখেছি তার ইয়াত্তা নেই। আবার বই পড়ে একাকি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছি। মাঝরাতে বই পড়ে অট্টহাসির কারনে আম্মার কাছ থেকে মাঝে মাঝে বকাও খেতাম। বইয়ের কোন মজার ঘটনা মনে পরলে একা একাই হেসে উঠতাম। একা একা হাসতাম বলে ‘পাগল’ ডাকও শুনেছি। কিন্তু ওগুলোতে আমার মাথা ব্যাথা ছিল না।
এস.এস.সি. পাশ করার পর ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ঐ সময় আমার পরিচয় হয নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোর সাথে। মাঝে সাঝেই বই কিনতাম হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে। হাত খরচের পরিমান বেশি একটা ছিল না বিঁধায় খুব বেশি একটা কই কিনতে পারতাম না। তবে ঐ সময় আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধাঁর নিয়ে পরতাম। কারও কাছে ধাঁর করার অভ্যাসটা তখন থেকে গড়ে উঠে। তবে ধাঁর করা বই কখনই ফেরত দিতে ভুলি নি। বই মেরে দেয়ার অভ্যাসটা তখনো গড়ে উঠে নি।
ইউনিভার্সিটি সময়টা ছিল আমার বই পড়ার শ্রেষ্ঠ সময়। হাত খরচের পরিমান কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় বই কেনার পরিমান টাও কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর ঐ সময়টাতে আমার বন্ধু বিশেষত সম্রাট ও আবিদ এর বাসায় যাতায়াতের পরিমান বেশ ভালই ছিল। সম্রাটের বাসায় ওর বোনের আর আবিদের নিজস্ব লাইব্রেরী ছিল। ওদের বাসায় কোন বই দেখলে উল্টেপাল্টে দেখতাম। ভাল লাগলে বাসায় নিয়ে আসতাম। বই নিয়ে আসলে সহজে ফেরত দেয়া হত না। ওরা প্রায়ই ফোন করে বই ফেরত দিতে বলত। আবিদতো রীতিমত লিখে রাখত কবে কোন বই নিলাম আর কবে ফেরত দিলাম। সময় লাগলেও ওদের বই ঠিকই ফিরিয়ে দিতাম। আসলে এক একটা বই বেশ কয়েকবার পড়তাম। বার বার পড়তে খারাপ লাগত না।
আমি বই মেরে দিয়েছি খুব কম লোকেরই। আমি যাদের বই মেরেছি তাদের মধ্য আমার দুই বন্ধু সিফাত আর মোবাস্বরা অন্যতম। সিফাত আমেরিকা যাওয়ার আগে কয়েকটা বই নিয়েছিলাম। ও আমেরিকা চলে যাওয়ার আর ফেরত দেয়া হয়নি। আর মোবাস্বরার কাছে থেকে একটা বই এনেছিলাম। বইটা পুরোপুরি পড়া হয়নি আজও আর তাই ফেরতও দেয়া হয় নি। আমি যে কয়টা বই মেরেছি তার থেকে বেশির ভাগ লোকই আমার বই মেরে দিয়েছে।
আমি খেলাধুলায় ছিলাম একেবারেই বাজে। আমার আম্মা খেলাধুলায় অনেক পুরস্কার পেলেও আমি এযাবত কাল পর্যন্ত একটাও পাইনি। এমনকি সান্তনা পুরষ্কারও না। এ নিয়ে আম্মা হয়ত মাঝে মাঝে মনঃকষ্টে ভোগেন। তবে খেলাধুলায় না পেলেও পড়াশুনায় পেয়েছি অনেকবার। বেশির ভাগ পুরস্কারই ছিল বই। বেশ ভাল কিছু বই হাতে পেয়েছিলাম পুরস্কার হিসেবে। নিকোলাই অস্ত্রভোস্কি এর লিখা ইস্পাত ছিল এর অন্যতম। রাশিয়ার এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ ছিল এটা। এই বইটা পড়েই অনুবাদ এর প্রতি ভালবাসা জেগেছিল।
অনুবাদ অবশ্য আরও পড়েছিলাম। হ্যারি পটারের প্রথম ৪ টা বই। আমার খালাতো ভাই নাবিল এর ছিল বইগুলো। ওর সাথে আমার বেশ ভাল একটা প্রতিযোগিতা ছিল বই নিয়ে। তিন গোয়েন্দা, টিনটিন, হ্যারি পটার সহ বিভিন্ন বই নিয়ে প্রতিযোগিতা হত। দুজনে মিলে নিয়মিতই বইমেলায় যেতাম আর বই কিনতাম। আম্মা ও খালাদের কাছে আমাদের আবদার থাকত বইমেলায় নিয়ে যাওয়ার।
ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সময় ব্লগিং এর প্রতি বেশ ঝুকে পড়ি। সামহোয়্যার ইন ব্লগ আর প্রথম আলো ব্লগে তো নিয়মিতই লিখালিখি করতাম। ব্লগে অনেক বই নিয়ে আলোচনা হত। অনেক বইয়ের রিভিউ ও দেয়া হত। কিছু কিছু ব্লগার তো ই-বুক ও শেয়ার করতেন। ই-বুক এর ধারনাটা তখন থেকেই পাওয়া। অনেক ই-বুক পরেছি ইন্টারনেট আর ব্লগ থেকে। বেশ কিছু দুর্লভ বইও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ব্লগের কল্যাণে। একটা সময় সামহোয়্যার ইন ব্লগ আর প্রথম আলো ব্লগ রাজনৈতিক ব্লগে পরিনত হয়। ঐ ব্লগ দুটোতে লেখা ছেড়ে নিজের একটা ব্লগ শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকের ব্লগারদের সাথে বেশ ভাল পরিচয় ছিল। বই মনা কয়েকজন ব্লগার ফেসবুকে বইপোকা নামে একটা গ্রুপ খুলেছিলেন। তখন থেকে অনেক বই সম্পর্কে জানতে পেরেছি ঐ গ্রুপের মাধ্যমে। অনেক ইচ্ছা থাকার পরও ঐ বইগুলো পড়ার সময় করে উঠতে পারিনি কারন ততদিনে আমি সিএ পড়া শুরু করেছি।
সিএ এর পাশাপাশি সিএমএ আর এমবিএ ও শুরু করেছিলাম। এতকিছু একসাথে শুরু করার কারনে অবসর সময় একদমই পেতাম না। সারাদিন বিভিন্ন কোম্পানিতে অডিট করে রাতে বসতে হত প্রফেশনাল হিসাব নিরিক্ষক হওয়ার পড়াশুনা নিয়ে। আডিট সহকারী হিসেবে আমাকে নিয়মিতই হিসাব বিজ্ঞান আর হিসাব নিরীক্ষার বিভিন্ন নিয়মনীতির পাশাপাশি পড়তে হত বিভিন্ন আইন ও বিধি। এগুলোর চাপে পড়ে গল্প উপন্যাস পড়ার সময়ই মিলত না। তবু মাঝে মাঝে সহকর্মীদের সাথে বিভিন্ন বই নিয়ে কথা হত। বিশেষভাবে ওয়াহিদ আর আডিট ম্যানেজার আরিফ ভাইয়ের সাথে আলোচনা করতাম কি কি বই পরেছি, কোনটা বেশি ভাল লেগেছে কার কোন বই কার কাছে আছে। ওয়াহিদের কাছ থেকে কিছু বই নিয়ে পড়ার কথা থাকলেও সময় হয়ে উঠে নি।
কিছুদিন ধরেই বই পড়ার অভ্যাসটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সিএ ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে ধার করে একটা বই পড়ে ফেলেছিলাম। এখন পরীক্ষা শেষ আর তাই বেশ ভাল ভাবেই মিস করছি বই পড়া। শীঘ্রই কিছু বই কিনে ফেলতে হবে। কি ধরনের বই পরব ঠিক করতে পারছি না। নীলক্ষেত এ একদিন ঢু মারতে হবে। পড়ার টেবিলের তলা থেকে পুরনো বইগুলো বের করে আপাতত পড়া যাক!