ভূমিকাঃ
গত বছর বই মেলা শেষ হওয়ার পর রকমারী থেকে বইমেলার বেস্টসেলার কিছ বইয়ের অর্ডার দিয়েছিলাম। তাঁর মধ্যে একটা বই ছিল লেখক সাদাত হোসাইন এর উপন্যাস ‘মরনোত্তম’। বইটা কেমন তা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা ছিল না। গত কয়েকদিন আগে নিজের বইয়ের সংগ্রহশালা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হাতে পড়ল উপন্যাসটি। বইয়ের মলাটের ভিতরের দিকে উপন্যাসের কাহিনী সংক্ষেপ পড়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এটা পড়ে ফেলব। কিন্তু কিছু আর পড়া হচ্ছিল না। গতকাল ফেসবুকে একটা পত্রিকার খবর দেখলাম যে খ্যাতনামা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সম্প্রতি মরনোত্তম নামে একটি টেলিফিল্ম এর শুটিং শেষ করেছেন। সাথে তাঁর একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে যেখানে তাঁর গলায় একটি ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলানো যাতে লিখা আছে ‘আমিই কোহিনুরের বাবা…‘। এটা দেখে হটাৎ মনে হল কথা গুলো কথায় যেন পড়েছি। পরে মনে পড়ল যে এটা তো কয়েকদিন আগেই আমার বইটায় পড়েছি। তারপর মনে পড়ল বইয়ের নাম ‘মরনোত্তম’ আর অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন যে টেলিফিল্ম করছেন তাঁর নামও ‘মরনোত্তম’। তারপর খুব আগ্রহ নিয়ে পত্রিকার খবরটি পড়লাম (লিংক এইখানে)। ঈদ উপলক্ষ্যে ইলিয়াস কাঞ্চন এ টেলিফিল্মে অভিনয় করছেন। এটা জানার পর মনে হল যে টেলিফিল্ম যেহেতু হয়েছে, বইটি নিশ্চয়ই ভাল হবে। এবং আসলেই তাই। এখন আসুন উপন্যাসটির লেখক সম্পর্কে একটু জেনে নেই।
লেখক পরিচিতিঃ
সাদাত হোসাইন নিজেকে বলেন গল্পের মানুষ। ২০১৫ সালে ‘আরশিনগর’ উপন্যাস দিয়ে তিনি মূলত বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে পৌছে যান। এরপর একে এক লিখেছেন তুমুল পাঠকপ্রিয় উপন্যাস ‘অন্দরমহল’, ‘মানবজনম’, ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’, নির্বাসন’, ‘ছদ্মবেশ’ ও ‘মেঘেদের দিন’। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন এসবিএসপিআরপি ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরষ্কার, পশ্চিমবঙ্গের চোখ সাহিত্য পুরস্কার, শুভজন সাহিত্য সন্মাননা। সম্প্রতি তিনি ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ‘এক্সিম ব্যাংক- অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯। তাঁর মতে সকল সৃষ্টিশীল মাধ্যম মূলত গল্প বলে। তিনি গল্প বলেছেন চলচ্চিত্রেও। তাঁর নির্মিত নির্বাক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বোধ’ এবং ‘দ্যাশুজ’ আলোড়ন তুলেছে বিশ্বব্যাপী। জিতেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ও শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ট স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকারের পুরস্কার। সম্প্রতি তিনি নির্মান করেছেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য মিউজিকাল ফিল্ম ‘গহীনের গান’। জীবনের গল্প আর গল্পের জীবনে তাঁর নিরলস বিচরণ।
কাহিনীসংক্ষেপঃ
প্রেসক্লাবের সামনে ভিড় বাড়তে বাড়তে চলে এসেছে রাস্তা অবধি। অফিসফেরত বাসযাত্রীদের বাসগুলো আটকে পড়েছে। ফলে রাস্তার জ্যাম ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্চে। কৌতুহলী মানুষ তাদের জরুরী কাজ ফেলে ভিড়ের পেছলে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পিছন থেকে সামনের ঘটনার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গলে কেউ কেউ উঠে গেছে ওভারব্রিজের ওপরে। দু-একুজন তরতর করে রেইন্ট্রি গাছের ডাল বেয়ে উঠে গেছে। আশেপাশের বাসা, অফিসের ছাদেও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা কি?
ঘটনা হল ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়ানো শীর্নকায় মানুষটা। তাঁর নাম আজিজ মাষ্টার। আজিজ মাষ্টার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসক্লাবের সামনে। তাঁর বাঁ হাতে ধরা একখানি মশাল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সেই মশাল থেকে গায়ে আগুন ধরাবেন। কিন্তু একটু দেরী করছেন। কারন তাঁর গলায় একখানে ছোট ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলানো। সেই ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে স্পষ্ট বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘আমিই কোহিনুরের বাবা…‘।
আজিজ মাষ্টার ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর বাবার নামে গড়ে তোলা দবির খাঁ মেমরিয়াল স্কুলটিকে এমপিও ভুক্ত করার দাবি নিয়ে। অনেক চেষ্টা চরিত করেও যখন কোন দিক করতে পারছিলেন না তখন তাঁর স্কুলের এক শিক্ষকের পরামর্শে ঢাকায় এসেছিলেন আমরণ অনশন করতে। কিন্তু বিভিন্ন বাঁধার মুখে অনশন করার চেষ্টা ব্যাহত হয়। অনশন করার সময় আসাদ নামের এক কবির সাথে পরিচয় হয়। আসাদ প্রথমেই আজিজ মাষ্টার কে সন্দেহ করে যে স্কুলের দাবীর আড়ালে হয়ত তাঁর আলাদা কোন উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু আজিজ মাষ্টার তা মানতে নারাজ। আসাদের কথায় আজিজ মাষ্টার বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। কিন্তু পথিমধ্যে তাঁর মনে হয় তাঁর মনের মধ্যে যে অনুশোচনা লুকিয়ে আছে তাঁর প্রতিবাদ না করলে তাঁর বাড়ী যাওয়া সমীচীন হবে না। তাই যাত্রাভঙ্গ করে আজিজ মাষ্টার ফিরে আসেন প্রেসক্লাবের সামনে আত্মাহুতি করে প্রতিবাদ করতে।
পর্যালোচনাঃ
উপন্যাসটির শুরুটাই হয়েছে আজিজ মাষ্টারের ঢাকা যাত্রার দিয়ে। এটি দিয়েই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে নিয়েছেন লেখক। ক্রমশ তিনি ঢাকা যাত্রার পটভুমী পাঠকদের জানাতে শুরু করেন। নিজের বাবার স্মৃতিতে গড়ে তোলা স্কুলটির নামকরন করেছেন দবির খাঁ মেমোরিয়াল স্কুল। এই স্কুল নিয়ে বিভিন্ন আর্থিক এবং সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হন তিনি। কিন্তু পিছ পা হন নি। লেখক পুরো উপন্যাসটি সাজিয়েছেন এই স্কুলটি ঘিরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে। এই ঘটনাক্রম গুলো লেখক পাঠকের কাছে উন্মোচিত করেছেন বেশ রহস্যময় করে। লেখক আমাদের সামনে তুলে এনেছেন আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা যেখানে সবাই মেনে নিয়েছে যে নিজের সমস্যা না হলে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কেউ ভাবে না যে এই সমস্যা একদিন আমারও হতে পারে। কেউ সমস্যা সামনে নিয়ে আসলে সবাই শুধু দর্শকের ভুমিকা পালন করে। ডিজিটাল সংস্কৃতি আমাদেরকে সংযুক্ত করেছে বিশ্বের কাছে কিন্তু ব্যবধান গড়ে দিয়েছে বাস্তবতার সাথে। উপন্যাসে লেখক তুলে ধরেছেন আমাদের সমাজের কিছু বাস্তব কিন্তু অপ্রিয় সত্য। দেখিয়েছেন কিভাবে ক্ষমতার আড়ালে নিজের অপকর্ম গোপন করে আর কিছু মানুষ ন্যায় বিচার না পেয়ে অনুশোচনায় আগুনে দগ্ধ হতে থাকে। উপন্যাসের কথোপকথনের এক জায়গায় লেখক লিখেছেন ‘জীবিত মানুষটির চেয়ে মৃত মানুষটি যেখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, সেখানে মরণই তো উত্তম‘। লেখক খুব সুন্দর করে দেখিয়েছেন যে আমাদের রাজনীতির চালে একজন মানুষ যে তাঁর সারা আন্দোলন করে পরাজিত হয়ে কিভাবে বীরের মর্যাদা পায়। জীবিত থাকার সময় মূল্যহীন হলেও মৃত্যু তখন অনেক অর্থবহ হয়ে উঠে। কিন্তু জীবিত মানুষটি কিন্তু তখনও মূল্যহীনই থেকে যাচ্ছে।
উপন্যাসের লিখনী বেশ প্রাঞ্জল। এক নিমিষেই গল্পের ভিতরে ঢুকে যেতে পারেবে পাঠকগন। উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন বেশ মুন্সিয়ানার সাথে। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটি আমাদের সমাজের লুকায়িত খুঁতগুলো পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছেন অসাধারন ভাবে।
রেটিংঃ
বইটিকে আমি ৭/১০ দিব। আমার রেটিং শুধু আমার নিজের ভালোলাগা থেকে। আমার এ রেটিং অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। তবে এটুকু বলতে পারি বইটি সবার ভাল লাগবে।
পুনশ্চঃ
আজিজ মাষ্টার চরিত্রে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনকে অসাধারন মানাবে আমি নিশ্চিত। তাঁর মত গুনী অভিনেতাই পারবেন আজিজ মাষ্টারকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে টেলিফিল্মটি দেখার অপেক্ষায় আছি।
বই সংগ্রহের জন্যঃ রকমারী.কম এ দেখুন।