ক্লাস ফাইভে একবার “aim in life” রচনা লিখতে বলেছিল। আমার এক চাচা কে দেখে তখন আমারও চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হওয়ার স্বপ্ন। তো রচনা লিখতে গিয়ে দেখি ইংরেজিতে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট লিখতেও পারি না এবং চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এর কি কাজ তাও জানি না। শুধু জানতাম এরা টাকা পয়সা নিয়ে কাজ করে। তো আমি তখন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এর কথা বাদ দিয়ে লিখে দিলাম ব্যাংকার হব।
এর পর ক্লাস নাইনে কমার্সে পরি। কোচিং এর মডেল টেষ্টে আবার “aim in life” লিখতে হল। তখনও আমি চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট বানান বা এদের কাজ সম্পর্কে কিছুই জানি না। তো এবার আমি মুখস্ত লিখে দিলাম যে ডাক্তার হয়ে সমাজ সেবা করব। মডেল টেস্টের রেজাল্ট দিন শিক্ষক আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং সবার সামনে আমার মহান ইচ্ছার কথা প্রচার করে দিলেন। কমার্সে পরে ডাক্তার হবার ইচ্ছা শুনে সবাই খুব অনুপ্রাণিত হল।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ ও পার করে ফেললাম। কলেজ পাশ করার পর আরেক বন্ধু সহ চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হবার আশায় একটি বড় চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ফার্মে যাই ভর্তির আশায়। কিন্তু ফরমাল ড্রেসে না যাওয়াতে মোটামুটি অপদস্থ করে আমাদের বের করে দেয়া হল। রাগে দু:ক্ষে আমার বন্ধুর চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হয়ার স্বপ্ন উবে গেল আর আমার জেদ আরো বেড়ে গেল। তখনো কিন্তু জানি না চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এর কি কাজ। শুধু জানতাম যে এটা পাশ করা খুব কঠিন।
চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ফার্মে ঢুকতে না পারার কষ্টে এর পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এ গমন। তখনও চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হবার স্বপ্ন বহাল তবিয়তে বর্তমান। “Young Adult” এর ভাব নিতে নিতেই কিভাবে কিভাবে প্রথম সেমিস্টার পার করে দিলাম। দ্বিতীয় সেমিস্টারে এসে পরিচয় হল ফিন্যান্স আর মার্কেটিং এর সাথে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে হাবুডুবু খেলাম আর ভুলে গেলাম “চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট” এর পুরাতন স্বপ্ন। আরো তিন-চার সেমিস্টার পার হবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম CFA করে ‘ফাইনান্সিয়াল এনালিস্ট’ হব। একবার তো সাহস করে নীলক্ষেত থেকে প্রথম লেভেলের বই কিনে আনলাম। বই খুলে আর পরীক্ষা খরচ দেখে ইচ্ছে টাকে তাকে তুলে রাখলাম। আবার মনের ভেতর উকি দিল “চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট”। ফিনান্স রেখে এবার একাউন্টিং এ মন দিলাম। সাথে আবার মার্কেটিং এর সাথে লুকুচুরি খেলা। অবশেষে “মার্কেটিং” এবং “একাউন্টিং ও ফিনান্স” এ মেজর করে বিশ্ববিদ্যালয় এর পাট চুকালাম।
অত:পর কি করব এটা নিয়ে পড়লাম অথৈ সাগরে। চাকুরীতে যাব না এমবিএ করব নাকি সিএ/আইসিএমএবি এ ঢুকব নাকি প্রবাস জীবন বেছে নেব। একাধিক বিকল্প থাকলে যা হয় আরকি। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা হাতে কলমে প্রয়োগ করলাম। খাতা কলম নিয়ে বসলাম প্রত্যেক বিকল্পের সুবিধা-অসুবিধা বের করার জন্য। অনেক চিন্তাভাবনা করে পরিবারের সম্মতি নিয়ে সিএ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এখন সিএ ফার্মে ঢুকার পালা। কিন্তু কোন ফার্মে ঢুকব বা কিভাবে ঢুকব তার ব্যাপারর কোন ধারনাই ছিল না। শিক্ষানবিশ থাকার সময় রাজ্জাক ভাই এর সাথে পরিচয় হয়েছিল। উনি ছিলেন একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। তো তাকেই ধরলাম সিএ ফার্মে রেফার করার জন্য। উনি তখন রেফার করলেন এ. কাশেম এন্ড কোং চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস এ। মাস খানেক পর ভর্তি পরিক্ষা দিলাম কিন্তু আর কোন খবর নাই। এর মাঝখানে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বন্ধু আইসিএমএবি তে ভর্তি হচ্ছে। যেহেতু সিএ ফার্ম থেকে কোন খবর আসছে না এবং আইসিএমএবি ও আমার একটা বিকল্প ছিল, তাই কিছু না ভেবেই ভর্তি হয়ে গেলাম। এখানে একটা সুবিধা ছিল যে চাকুরীর পাশাপাশি আইসিএমএবি তে পড়াশুনা করা যায়। তাই চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হবার স্বপ্ন পুরোপুরি বাতিল করে চাকুরীর সন্ধান শুরু করলাম।
কয়েক জায়গায় চাকুরীর ইন্টারভিউ দেয়ার পর ২০১২ এর মার্চের শেষ দিক একদিন একটি কোম্পানীতে একাউন্ট্যান্ট হিসেবে চাকুরী প্রস্তাব পাই। এপ্রিলের ১ তারিখে শুক্রবার থাকার কারনে ২ তারিখে যোগদান করতে বলা হয়। মনে মনে খুশি যে যাক চাকুরী একটা পেলাম।
মজার ব্যাপার চাকুরীর নিশ্চিত হবার ফোন পাবার ঠিক ১০ মিনিট পরই এ. কাশেম এন্ড কোং থেকে ফোন পাই এবং এপ্রিলের ২ তারিখে সিএ শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করতে বলা হয়। একই দিনে দুই জায়গা থেকে প্রস্তাব আসাতে কিছুটা দ্বিধার মধ্যে পড়তে হয়। এ যেন বিয়ে করতে যাবার সময় এক্স-গার্লফ্রেন্ডের ফোন পাবার মত। ঠিক করলাম পুরনো কে নিয়ে আর মাথা ঘামাব না। ২ তারিখে চাকুরীতেই যোগদান করব।
২ তারিখ সকাল বেলা বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মনে খুব দোটানা চলছে। একদিকে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হবার এত দিনের স্বপ্ন অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত বেশি বেতনের চাকুরী। আমি নিশ্চিত বাংলা সিনেমা হলে কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেজে উঠত, ঝড় বৃষ্টি হত, বিজলী চমকাত, ৩৬০ এংগেলে আমাকে ভিডিও করত। যেহেতু সিনেমা ছিল না তাই এমন কিছুই হয় নি। সকালের নাস্তা করতে করতে আব্বার সাথে কথা বললাম। আব্বা বললেন “এত চিন্তা করার কি আছে। সিএ করার তো পুরানো প্লান। তোমাকে আপাতত পরিবারে কোন টাকা পয়সা দিতে হবে না। বরং তোমার পড়ার জন্য কিছু টাকা আলাদা করা আছে।” আব্বার কথায় ভরসা পেলাম। অনেকটা বাংলা সিনেমাতে যেখানে বাবা সন্তানের প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিয়ে নিজের আয়োজিত বিয়ে বাতিল করে দেন। চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হবার স্বপ্ন তখন আবার ভর করল মাথায়। এবার আর ছেড়ে দিলাম না। সিনেমার নায়করা যেমন দৌড়ে দৌড়ে প্রেমিকার কাছে ছুটে যায়, আমি অবশ্য তা করি নি। চাকুরীর জন্য মতিঝিলের বাস না ধরে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হবার স্বপ্ন নিয়ে গুলশানের বাস ধরলাম।
পুনশ্চ:
আমি ২০১২ সালের এপ্রিলের ২ তারিখে আর্টিকেল ষ্টুডেন্ট হিসেবে এ. কাশেম এন্ড কোং তে যোগদান করি আর ২০১৫ সালের অগাস্ট মাসের ২০ তারিখে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হিসেবে উত্তীর্ণ হয়ে ২৩ তারিখে আইসিবি এর সদস্য হই । প্রসংগত বলে রাখি ২০১৮ সালে আইসিএমএবি পাশ করে এরও সদস্য হই। কি করে আইসিএমএবি পাশ করলাম সেটা নিয়ে আরেকদিন লিখা যাবে।