আজকেই সম্ভবত আমি আমার ছাত্রত্বের ইস্তফা দিলাম। পড়াশুনার পাট চুকিয়েছি বছর পাঁচেক হল। সেই ১৯৯৫ এ প্রাথমিক দিয়ে যে ছাত্রজীবনে প্রবেশ করেছিলাম তার সমাপ্তি টেনেছিলাম ২০১৯ এ। মাঝে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। এর মধ্যে কয়েকটি পেশাদার ডিগ্রীও শেষ করেছি। তবু আমার ছাত্রজীবনের অবসান হয়েছে বলে মনে করতাম না।
সব পরীক্ষা পাশ করার পর আমার পড়ার টেবিল খানি আর খুব বেশি ব্যবহার করা হত না। পেশাগত কারনে মাঝে সাঝে কাজের জন্য অথবা নিজেকে হাল নাগাদ করেতে পড়তে হয় বটে কিন্তু তা আর ঠিক ছাত্রজীবনের পড়াশোনার তুলনায় কিছুই না। বিয়ের পরে আমার রুমের সব আসবাব পরিবর্তন করেলেও আমার টেবিল খানি স্বস্থানে বহাল ছিল। আমার স্ত্রীর প্রবল আপত্তিও এটাকে সরাতে পারে নি। ছাত্রজীবনের বইগুলো তো সেই কবেই জলাঞ্জলী দিয়েছিলাম। এই টেবিলটাই ছিল আমার ছাত্রজীবনের একমাত্র অবশিষ্টাংশ। টেবিল টা দেখলেই নিজেকে এখনো ছাত্র বলে মনে হত। কাজের প্রয়োজনে নিজের একটি ব্যক্তিগত অফিসকক্ষ নিলেও তাই টেবিলটা কে নিজের শয়নকক্ষ থেকে বের করি নি। তাছাড়া টেবিলটার প্রতি আমার আলাদা একটা টান কাজ করে কারন এটা একটা পারিবারিক ঐতিহ্য এর মতন। শুনেছি আমার বড় চাচা নাকি এটাতে পড়াশোনা করেছেন। তিনি স্নাতক পাশ করার পর এটা আমার বাবার হাতে আসে। আমার বাবাও এই টেবিলে পড়াশোনা করেছেন। মাঝে অনেক বছর এটার ব্যবহার না হলেও আমার ছাত্রজীবন শুরু হতে টেবিলটি আমার দখলে আসে।অনেক পুরাতন টেবিল হলেও এটা বর্তমানের যে কোন নতুন টেবিলের চেয়েও মজবুত। বেশ কয়েকবার এটাতে কিছু সংস্কার কাজ এবং খানিক পরিমার্জন করা হয়েছিল। আমি কলেজে পড়ার সময় আমি এই টেবিলটির বেশকিছু অংশ সংযোজন করেছি। সম্পুর্ন নিজের করা নকশাতে টেবিলে উপরে এবং পায়ের কাছে বই রাখার জন্য তাক সংযুক্ত করেছিলাম। আর রং এর কাজ তো ছিলই। এতে টেবিলটি ভারী হয়ে যায়। এটাকে নাড়াচাড়া করাও অনেক কঠিন ছিল বিধায় এতদিন এটাকে আর নাড়াচাড়া করা হয় নি। তবে আজকে আর নাড়াচাড়া না করে পারলাম না।
সম্প্রতি পোষাক-পরিচ্ছেদ গুছিয়ে রাখার জন্য ঘরে নতুন আসবাবপত্রের প্রয়োজন বোধ হলে নতুন একটি আসবাব তৈরীর আদেশ দেয়া হয়। নতুন আসবাব রাখার জন্য স্থান নির্বাচন করেতে গিয়ে দেখা গেল টেবিলটি না সরালে রুমে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। অবশেষে আজকে নতুন আসবাব আসার আগেই টেবিলটিকে শয়নকক্ষ থেকে বিতারিত করা হল। টেবিলটি রুম থেকে বের হতেই মনে হল আমার ছাত্রজীবনের যে ছোট্ট অংশটুকু ধরে রেখেছিলাম, তারও আজ যবনিকাপাত হল। নিজেকে আর ছাত্র বলতে ইচ্ছে হবে না। বাসে উঠলে হাফ ভাড়া দিয়ে ইচ্ছে করবে না।
যাই হোক, টেবিলটিকে শয়নকক্ষ থেকে বিতারিত করা হলেও বাসা থেকে বিতারিত করা হয়নি। আর এটির ব্যবহারও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আমার বড় ভাগ্নীর পড়ার টেবিলের পরিবর্তন দরকার ছিল। তাই উত্তোরাধিকার সুত্রে এই টেবিলের মালিক এখন আমার বড় ভাগ্নী। তার কাছে হস্তান্তর করে পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখেছি। আশা করছি একদিন সে তার ছোট বোনকে হস্তান্তর করবে। এইভাবে এই টেবিল প্রজন্মের পর প্রজন্মের পড়াশুনার অংশ হয়ে থাকবে।