কয়েকদিন আগে আমার ছোট ভাগ্নী আমাকে অনুরোধ করেছিল তাকে কয়েকটি ডাকটিকেট আর খাম কিনে দিতে। স্কুলে এসাইনমেন্ট হিসেবে চিঠি লিখতে হবে এবং ডাক ঘরে পোষ্ট করতে হবে। ব্যবস্থা করে দিব বলে ওকে আপাতত বিদায় দিলাম। কিন্তু মনে মনে হিসেব কষলাম আমি সবশেষ চিঠি পোষ্ট করেছিলাম কবে?
ডাকঘরে সর্বশেষ চিঠি পোষ্ট কবে পোষ্ট করেছিলেন এমন প্রশ্ন কাউকে করা হলে যে কারও কিছুক্ষন ভাবতে হবে।নিজেরপ্রশ্নে নিজেই আটকে গিয়েছিলাম। কোন ভাবেই মনে করতে পারিনি। পোষ্ট করার কথা ছেড়ে দিলাম। পরিক্ষার খাতা ছাড়া ব্যাক্তিগত চিঠি পত্র সর্বশেষ কবে লিখেছিলাম সেটাই কোন ভাবেই মনে করতে পারিনি। প্রায় সব কিছু তো এখন ইমেইল বা খুদেবার্তায় সেরে ফেলা যায়। আমাকে অবশ্য মাঝেসাঝে অফিসের কাজে কিছু চিঠিপত্র পাঠাতে হয়। কিন্তু সেগুলো সবই পাঠানো হয় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে যাতে প্রাপক খুব দ্রুতই চিঠি হাতে পায়। ডিজিটালাইজেশনের যুগে এই কুরিয়ার করার সংখ্যাও কমে আসছে। সরকারী পোষ্ট অফিসে তো আর যাওয়াই হয় না। আমার ধারনা পোষ্ট অফিস সঞ্চয় স্কিম বাদে আর কেউ যায়ও না। আর সরকারী দপ্তরগুলো ছাড়া আর কেউ ডাক সেবা ব্যবহার করে চিঠিপত্র পাঠায় না।
পোষ্ট অফিসের প্রতি আমার আলাদা একটা টান কাজ করে। ছোটবেলায় ডাক টিকেট জমানোর শখ ছিল। আমার সহপাঠীদের অনেকেরই একই শখ ছিল। তারা অবশ্য বাসায় আসা চিঠি থেকে ডাক টিকেট খুলে জমাত। অথবা আত্মীয়দের কেউ কেউ বিদেশ থেকে ডাক টিকেট নিয়ে আসত। আমার অবশ্য সেরকম সুযোগ ছিল না। বাসায় কোন চিঠিও আসত না আর বিদেশ থেকে কেউ নিয়েও আসত না। একই পরিস্থিতি ছিল আমার বন্ধু মামুনেরও। কিন্তু আমাদের ডাক টিকেট জমানোর খুব শখ। আমারা টিফিনের টাকা বাচিয়ে ডাকঘর থেকে ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা বা ১ টাকার টিকেট কিনতাম। আমাদের একটা করে খাতা ছিল যেখানে আমারা এইসব কেনা ডাক টিকেটগুলো লাগিয়ে রাখতাম। ডাক টিকেটের খাতা সবসময় আমাদের ব্যাগে থাকত।
ডাকঘর থেকে আমার স্কুলের দুরুত্ব খুব বেশি ছিল না। ৫-১০ মিনিটের হাটা পথ। বেশির ভাগ সময়ই আমরা স্কুল ছুটির পর বা টিফিন পিরিওডে ডাকঘরে চলে যেতাম। ডাক ঘরের একজন কর্মচারী আমাদেরকে ডাক টিকেট দেখাতেন। নতুন কোন টিকেট আসলে বলতেন। কিন্তু পকেট গরিব বলে ২৫ পয়সা থেকে ৫০ পয়সার টিকেটই বেশি কেনা হত। ডাকঘরের সিঁড়িতে বসে খাতায় ডাক টিকেট লাগাতাম। কখনও ডাকঘরে যাওয়ার সুযোগ না পেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথের যে কোন লাইব্রেরী থেকে ডাক টিকেট কিনতাম। তখন লাইব্রেরী তে ডাক টিকেট সহ বিভিন্ন রঙয়ের খাম পাওয়া যেত। সরকারী খাম তো ছিলই।
একদিন আমাদের ডাক টিকেটের খাতায় সদ্য কেনা কিছু টিকেট লাগাচ্ছিলাম। এমন সময় অপরিচিত একজন বয়স্ক মানুষ আমাদের কাছে জানতে চাইলেন যে আমরা খাতায় টিকেট কেন লাগাচ্ছি। টিকেট জমানোর কথা শুনে বললেন যে এভাবে তো টিকেট জমায় না। টিকেট জমাতে হয় এমন ভাবে যাতে এক টিকেট দুটা না হয়। তোমাদের কাছে একই টিকেট তো অনেক গুলো। এগুলো তো আর ব্যবহারও করেতে পারবে না। এতে টিকেট এবং তোমাদের টাকা দুটাই নষ্ট হচ্ছে। একথা শুনে আমাদের টিকেট জমানোর পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসল। একই টিকেট দুটি রাখা যাবে না। কিন্তু এতে দেখা গেল কদিন পরেই আর নতুন টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। সম্পুর্ন নতুন টিকেটের অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে আমার টিকেট জমানোর শখ শিকেয় চড়ল। এখন যদিও আর টিকেট সংগ্রহ করি না কিন্তু তবুও ডাক টিকেট দেখলে মনে হয় খুলে রাখি।
ভাগ্নীকে ডাক টিকেট আর খাম কিনে দিব বলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। গত পরশু রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে দেখি ওর মুঠোফোনে ওর খুদেবার্তা। মনে পড়ল টিকেট কেনার কথা। কিন্তু ততক্ষনে রাত প্রায় নয়টা। ডাকঘর তো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। লাইব্রেরী গুলোও বন্ধের পথে। আমি ফেরার পথে যে কয়টা লাইব্রেরী দেখলাম প্রায় সবগুলোতেই খোঁজ নিয়ে ডাক টিকেট পেলাম না। আসলে কেউ আরে চিঠি লিখে না তাই কোন লাইব্রেরীই আর ডাক টিকেট বিক্রি করে না। ভাগ্নীর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ওর হাতে আরো একদিন সময় আছে ডাক টিকেট সংগ্রহের জন্য। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে দিনের বেলা ডাকঘর থেকে টিকেট কিনে দিব।
পরদিন সকালে (মানে গতকাল) বেলা আনুমানিক ১১ঃ৩০ এর দিকে গেলাম এলাকার সাব-পোস্ট অফিসে। প্রায় ১৫ বছর আগে কি কাজে যেন গিয়েছিলাম একবার এই সাব-পোস্ট অফিসে। বেশ ভিড় ছিল তখন। কিন্তু এবার দেখি সম্পুর্ন উল্টা চিত্র। খুব সুন্দর পরিপাটি অফিস। কোন ভিড় নেই। ডাকঘরের দুজন লোক বসে পত্রিকা পড়ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব বেশি কাজ নেই হাতে। ডাক টিকেট আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই পাল্টা প্রশ্নে তারা জানতে চাইল কি জন্য। চিঠির জন্য বলার পর একজন টিকেটের একটা রোল বের করল। তাতে ১ টাকা, ২টাকা, ৩ টাকা, ৫ টাকা আর ১০ টাকার কিছু ডাক টিকেট ছিল। যদিও এতগুলোর প্রয়োজন ছিল না তবুও প্রত্যেকটা থেকে ৫/৬টা করে ডাক টিকেট কিনে নিলাম। সাথে কিছু সরকারী খাম। এরপর অনেক্ষন ধরে ডাকঘরের লোকদের সাথে কথা বললাম। জানাল যে আজকাল প্রায় ফাঁকাই থাকে এই ডাকঘরটি। আমি মনে মনে ভাবলাম এককালে অতিব্যস্ত ডাকঘর গুলো প্রায় খালি পড়ে আছে। অথচ এই ডাকঘরগুলোকে আধুনিকায়ন করে কুরিয়ার সার্ভিসের মত রুপান্তর করতে পারলে ডাক বিভাগের পুরোনো রূপ হয়ত ফিরে পাওয়া যেত।
পুনশ্চঃ
ডাকটিকেট কেনার পর পরই আমার স্ত্রী ফোন করে জানালো সেও বেশ কিছু টিকেট কিনেছে। অতঃপর সবগুলোই আমার ছোট ভাগ্নীকে হস্তান্তর করা হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সে তার টিকেট গুলোর কিছু তার অসহায় সহপাঠীর কাছে বিক্রয় করেছে এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে ড্রিঙ্কো (Drinko) কিনে খেয়েছে।